একতার কণ্ঠঃ আন্দোলনে গিয়ে ৪৫ দিন ধরে নিখোঁজ শাহাদতের অপেক্ষায় তার মা ও পরিবার। বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব গোলচত্বর এলাকায় গত ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শাহাদত হোসেন (২১)। পরে ওইদিন রাতেই বন্ধুদের সঙ্গে সাভার যান তিনি। সেখান থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনে ঢাকার সাভারে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হন। ওইদিন বিকেলে শাহাদত তার মাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, সাভারে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, হয়তো বাসায় ফিরতে পারবেন না তিনি। এরপর আর খোঁজ মিলেনি তার। যে নম্বর থেকে শাহাদত ফোন করেছিলেন, সেটিও তখন থেকেই বন্ধ রয়েছে।
নিখোঁজ শাহাদত হোসেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আলীপুর গ্রামের আব্দুল হালিম ও আসমা খাতুনের একমাত্র সন্তান। শাহাদতের সানজিদা নামে পাঁচ মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘটনার পর থেকেই প্রতিবেশীরা শাহাদতের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মা আসমা খাতুন ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে হতাশায় দিন কাটছে তার। জীবিত বা মৃত একনজর দেখার আকাঙ্ক্ষা শাহাদতের স্ত্রী জিয়াসমিনের। এখন আর কাঁদতে পারেন না তিনি। স্বামী হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। এখন তাদের একমাত্র শিশু সন্তানের ভরণপোষণ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সে। পাঁচ মাস বয়সী শিশু সানজিদা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। আর কোনো দিন বাবার আদর পাবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। বাবা না থাকায় এই শিশুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মা জিয়াসমিন। শাহাদত পেশায় একজন ভেকুচালক (মাটিকাটা যন্ত্র) ছিল। তবে তার সংসার সচ্ছল ছিল না। গাড়ি চালিয়ে যা উপার্জন হতো তাতে সংসার চলতো কোনো মতে।
এদিকে আন্দোলনে ছেলে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কয়েকদিন কালিহাতী থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করতে গিয়েও ফিরে এসেছেন মা আসমা খাতুন। এরপর গত রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থানা পুলিশ তার জিডি নিয়েছেন।
জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব গোলচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শাহাদত। পরে ওইদিন রাতেই আন্দোলনে যোগ দিতে বন্ধুদের সঙ্গে সাভার যায় সে। এরপর ৪ আগস্ট সকালে তার স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে শাহাদত। স্ত্রীকে ফোনে জানান, খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরবে সে। এরপর ওইদিন বিকেলে শাহাদত তার মাকে অন্য একটি মোবাইল ফোন দিয়ে ফোন করে জানান, সাভারে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। সেখানে শুধু গুলি আর গুলি হচ্ছে। কোনো দিকে যাওয়ার মাধ্যম নেই। সেখান থেকে ফিরতে পারবে কিনা তা নিয়ে মাকে শঙ্কার কথা জানান তিনি। এরপর সেই ফোনে বারবার যোগাযোগ করলেও আর সংযোগ করতে পারেননি তার মা। কারণ ফোনটি এরপর থেকেই বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার পর শাহাদতের বাবা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গে ছেলের মরদেহ খুঁজেছেন। এ ছাড়া আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার।
শাহাদত প্রায় তিন বছর আগে বিয়ে করেন জিয়াসমিনকে। এরপর তাদের ঘরে কন্যা সন্তান হয়। এলাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বেকু (মাটিকাটার যন্ত্র) গাড়ি চালাতেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শাহাদত বিএনপির কর্মী ছিল। তার বাবার ও তার উপার্জনের টাকায় সংসার চলতো। ছেলেটা এলাকাতেও আন্দোলন করেছে। বন্ধুদের ডাকে ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হয় সে। তার একটি শিশু সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী শিশু সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান সরকার যেন নিখোঁজ শাহাদতের সন্ধান দেয় এবং এই অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।
নিখোঁজ শাহাদত হোসেনের স্ত্রী জিয়াসমিন বলেন, কাজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন আমার স্বামী। এরপর ঢাকায় গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। ফোনে আন্দোলনের কথা শোনার পরই ফিরে আসতে বললেও সে আসেনি। সে কি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে—সেটাও জানতে পারলাম না। কতদিন ধরে তার খোঁজ পাচ্ছি না। এক নজর দেখার ইচ্ছে জাগে, জীবিত বা মৃত মানুষটিকে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে। মেয়েটা কথা শেখার পর কাকে বাবা বলে ডাকবে।
শাহাদতের মা আসমা খাতুন বলেন, নানার পরিবার বিএনপি সমর্থিত হওয়ায় বিএনপি’র লোকদের সঙ্গেই চলাফেরা করতো শাহাদত। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে এলাকাতে। ৩ আগস্ট কাজের কথা বলে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় শাহাদত। এরপর ৪ আগস্ট বিকেলে অন্য একটি নম্বর থেকে জানায়, সে আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে। চতুর্দিকে গোলাগুলি হচ্ছে, অবস্থা ভয়াবহ। মনে হয় ফিরতে পারবে না। ফোনের ওপাশ থেকে অনেক গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপরই ফোন কেটে দেয় সে। এরপর আর তার খোঁজ পাইনি। আমার বাবাকে জীবিত বা মৃত এনে দেন। বাড়িতে এনে যেন একনজর দেখার পর গোসল করিয়ে অন্তত কবর দিতে পারি, তাতে মনকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারব।
নিখোঁজ শাহাদতের বাবা আব্দুল হালিম বলেন, তার মায়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গে খুঁজেছি ছেলের সন্ধান পেতে। কত মরদেহ মর্গে পড়েছিল, অথচ সেখানে ছেলের মরদেহ পাইনি। আমার ছেলের সন্ধান চাই। ছেলেকে হারানোর জন্য থানায় জিডি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু থানা পুলিশ জিডি নিতে রাজি হয়নি, তবে রবিবার নিয়েছে।
এ বিষয়ে কালিহাতী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম ভুঁইয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।