একতার কণ্ঠঃ ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর ‘বিজয় মিছিলে গিয়ে গুলিতে নিহত’ টাঙ্গাইলের হৃদয়ের লাশ ৪০ দিন পরেও পায়নি তার পরিবার।
মা রেহেনা বেগম এখনও অপেক্ষায় আছেন, জীবিত না ফিরলেও অন্তত শেষবার মৃত ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে চান তিনি।
হৃদয় (২০) টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়ার ছেলে। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিজের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চালাতে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় অটোরিক্সা চালাতেন হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হৃদয়।
গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর কোনাবাড়ির কাশিমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে হৃদয়ের সঙ্গে তার ভগ্নিপতি ইব্রাহিম ও বন্ধু রবিন ছিলেন।
এই দুজনেরই ভাষ্য, তারা পুলিশের গুলিতে হৃদয়কে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে এবং তার লাশ নিয়ে যেতে দেখেছেন। কিন্তু পরে আর চেষ্টা করেও হাসপাতাল মর্গ বা অন্য কোথাও হৃদয়ের লাশের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরে এ ঘটনার ভিডিও দেখেও স্বজনরা হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানান ইব্রাহিম।
১১ দিন অপেক্ষার পর গত ২৬ অগাস্ট কোনাবাড়ি থানায় ৫৭ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন বলে জানান হৃদয়ের ভগ্নিপতি ও মামলার বাদী ইব্রাহিম।
হৃদয়ের পরিবার জানায়, হৃদয় ছিলেন দুই বোনের এক ভাই। দুই বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা লাল মিয়া এলাকায় রিকশাভ্যান চালিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে লাল মিয়া আর কাজ করতে পারতেন না।
পরে বাধ্য হয়েই সংসারের খরচ চালাতে মে মাসে লেখাপড়ার পাশাপাশি হৃদয় অটোরিক্সা চালানো শুরু করেন। তখন বাবা-মা এক বোনের বাড়িতে থাকতেন।
আলমনগরে হৃদয়দের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটি জরাজীর্ণ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রেহেনা বেগম। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে তিনি সারাক্ষণ কাঁদেন আর ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। বাবা লাল মিয়াও ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, আগামী দিনে তার সংসারটি কীভাবে চলবে।
হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলছিলেন, বড় মেয়ের জামাইয়ের একটি ঘরে আমি স্ত্রী নিয়ে থাকি। ছেলে একটি ভাঙাচোরা ঘরে থাকে। ছেলেটা কোনাবাড়িতে অটোরিক্সা চালাতো। ঘটনার দিন লাল মিয়া ছেলেকে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু হৃদয় বলেছিল, ভাইয়ের (বোন জামাই) সঙ্গে যাবো। বাবাডা আর ফিরে এলো না। এখন আমার ছেলের মরদেহ ফেরত চাই।
হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমাদের খাবার ও হৃদয়ের পড়াশুনার খরচ যোগানোর জন্য কোনাবাড়িতে কাজ করতে গেছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে ছেলেকে দিয়েছি গাড়ি চালানো শিখতে। ছেলে গাড়ি চালাবে। সেই কিস্তির টাকা এখন কে দেবে? আমার ছেলেডাকে মাইরা ফেলেছে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের মরদেহ ফেরত দেন আমি দেখবো। আমি তারে ধরতে চাই। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হৃদয়ের বন্ধু রবিন বলেন, ৫ অগাস্ট বিকালে কোনাবাড়ির কাশিমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে হৃদয়, ইব্রাহিমসহ তারা গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। এ সময় পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি করে। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমরা একপাশে ছিলাম। আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। তখন হৃদয় ভয়ে একটি বাড়ির পাশে লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কে নিয়ে যায় এবং মারধর করে।
রবিন বলছিলেন, আমরা দূর থেকে এইটা দেখছিলাম। ভাবলাম, হয়তো মারধর করে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তারা গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় চতুর্দিকে গুলি করা হয়। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার মৃত্যু।
ভেবেছিলাম, পরিবেশ শান্ত হলে তার মরদেহ আনতে যাবো। পরে পুলিশ তার মরদেহ নিয়ে চলে যায়। ওইদিন রাত ১২টার পর যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গিটা পাই। তবে পুলিশ মরদেহ নিয়ে কোথায় রেখেছে সেটা আর জানতে পরিনি। পরে আশপাশে খোঁজ-খবর নিতে গেলে কয়েকজনের কাছে সেদিন সেখানকার ঘটনার একটি ভিডিও পান রবিন।
সেই ভিডিও দেখার কথা জানান হৃদয়ের ভগ্নিপতি ইব্রাহিমও। তিনি বলেন, ভিডিওটি আশপাশের বাসা থেকে ধারণা করা হয়েছিল। এরকম ছোট ছোট কয়েকটি ভিডিও দেখার কথা জানান তিনি।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মো. হামিদ। তার কোনাবাড়িতে একটি দোকান আছে। মিছিলের আগে হৃদয় সেই দোকানের সামনেই ছিলেন। সঙ্গে তার ভগ্নিপতিকেও দেখেছিলেন হামিদ।
তিনি বলছিলেন, আমি তাকে মিছিলে যেতে বারণ করেছিলাম। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করেছে। বোনের জামাই ইব্রাহিম দূর থেকে দেখেছেন কিভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়া সাহস পায়নি।
যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে দোকানদার হামিদ বলেন, হৃদয়ের মরদেহ যেন তার পরিবার ফিরে পায়।
কয়েকটি ভিডিওর একটিতে দেখা যায়, ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ এক যুবককে ধরে সড়কের উপর নিয়ে লাঠিপেটা করছে। এরপর তাকে চারদিকে ঘিরে মারধর করছে। চারদিকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন যুবক।
পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এরপর আবার চারজন পুলিশ সদস্য সেখানে আসেন। তাদের মধ্যে দুইজন হাত দুইজন পা ধরে তাকে চাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন মিলে যুবকের লাশ টেনে গলির ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। তখনও আশপাশে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরপর ওই তিনজন তার মরদেহ ফেলে চলে যায়। তার একটু পর আবার দুইজন এসে মরদেহটি গলির আরও ভিতর নিয়ে যাচ্ছে।
হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ঘটনার দিন বিকালেই মোবাইলে ভাইয়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়। তখন তিনি ভাইকে বাসায় চলে যেতে বলেছিলেন। তখন হৃদয়ের কাছে স্বামী ইব্রাহিমের খোঁজ-খবরও নেন।
এর আধা ঘণ্টা পর ইব্রাহিম স্ত্রী জিয়াসমিনকে মোবাইল করে হৃদয়ের মারা যাওয়ার কথা জানান। তখন জিয়াসমিন আবার হৃদয়ের মোবাইলে ফোন দেন। তখন একজন ফোন ধরে বলেন, মোবাইলটি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন।
জিয়াসমিন আক্তার বলছিলেন, ভাইয়ের আশা ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দিবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুলিশ শেষ করে দিল। যারা ভাইকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। দেশ স্বাধীনে যেন শহীদের খাতায় ভাইয়ের নাম থাকে।