একতার কণ্ঠঃ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহি করটিয়া হাটে ভিটি বরাদ্দের মাধ্যমে প্রতিবছর হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এতে করে চরম ক্ষতির মূখে পড়ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারাও।
সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছভাবে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সরাসরি ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এ কারণে সরকারি ইজারা মূল্য (ভিটি প্রতি) ৫৮৫ টাকার পরিবর্তে কয়েক হাত ঘুরে একটি ভিটির দাম পড়ে কয়েক লাখ টাকা।
এমনটা হওয়ার কারণে ব্যবসার আনুসাঙ্গিক খরচ বেড়ে গিয়ে সরাসরি প্রভাব পড়ে ক্রেতাদের ওপরে, বেড়ে যায় পণ্যের দাম। সরকারিভাবে ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হলে হাটে দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারাও কম মূল্যে তাদের চাহিদামত পণ্য ক্রয় করতে পারতেন।
ফলে হাটের সিন্ডিকেটের সদস্যদের কারণে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ ক্রেতারাও ক্ষতির সন্মুখিন হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে এ ঐহিত্যবাহী করটিয়া হাট থেকে অনেক সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলে মনে করছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, হাটে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের ভিটি ভাড়া বা অন্য কারো কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কিনে ব্যবসা পরিচালনা করেন। কিন্তু যারা প্রকৃত ভিটির মালিক তাদের মধ্যে অনেকেই হাটে কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। তারা সবাই রাজনৈতিক নেতা, নইলে জনপ্রতিনিধি অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজন। তাদের এ সিন্ডিকেটের কারণে ভিটিগুলো বিক্রি হয় দেড়, দুই এমনকি পাঁচ লাখ টাকাতেও। অথচ এসব ভিটির বাৎসরিক সরকারি ইজারা মূল্য (ভিটি প্রতি) ৫৮৫ টাকা।
মঙ্গলবার (১৪ জুন) করটিয়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই হাটে সাধারণ ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা ও বিক্রেতারা পণ্য কেনা-বেচায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বগুড়া থেকে আসা সোলায়মান মিয়া নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, গত বছরের তুলনায় এবার কাপড়ের দাম অনেক বেশি। তারপরেও ব্যবসা ও ক্রেতার চাহিদার কারণে বেশি দাম দিয়েই কাপড় কিনতে হচ্ছে।
করটিয়া এলাকার শাকের আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে হাটের কিছু জায়গা দখল করে ব্যবসা করেন তিনি। কিন্তু এবার বৈধভাবে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে নিজের নামে না দেওয়ায় তার মেয়ে ও ভাই এবং ভাতিজার নামে ভিটি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এগুলোর একটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেন এবং বাকি তিনটি ভাড়া দিয়েছেন।
শুধু প্রভাবশালী নয়, এ হাটে ভিটি আছে সরকারি চাকরিজিবীদেরও। তবে এসব জমি তারা নিজের নামে না করে নিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের নামে।
এমনই একজন হচ্ছেন করটিয়া এলাকার কালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আরিফ। এ হাটে তার তিন বোন, মা, মামা, মামাতো ভাইয়ের নামে নিয়েছেন আটটি ভিটি। পরে ওই ভিটিগুলো আবার একই এলাকার চাচাতো ভাই মো. ইসমাইল হোসেনের কাছে এক বছরের জন্য ভাড়াও দিয়ে দিয়েছেন।
ইসমাইল হোসেন জানান, আরিফের কাছ থেকে আটটি ভিটি লিজ নিয়ে তিনিও সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় আরিফ এগুলো তার বোন, মা, মামা ও মামাতো ভাইয়ের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন।
জানা গেছে, হাটে ভিটি বরাদ্দের প্রক্রিয়া করে জেলা প্রশাসন। এ কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ভিটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। পরে তাদের জানানো হয় হাটে নতুন করে কোনো ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হবে না। যারা ইতোমধ্যেই হাটের জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন, তাদের মধ্যেই ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় এলাকার প্রল্লাদ দাস, হেলাল উদ্দিন, ছানোয়ার হোসেন ছানু ও আনিসুর রহমান বিরু দীর্ঘদিন ধরেই করটিয়া হাট নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। আর তাদের মাধ্যমেই পুরো হাটে ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তাদের প্রত্যেকের নামে একটিসহ বিভিন্ন স্বজনদের নামে একাধিক ভিটি নেওয়া হয়েছে। পরে সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর ৪০-৫০ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ভিটিগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি গত ১০-১২ বছর ধরে এ হাটে ব্যবসা করছেন। ৪-৫ বার তিনি ভিটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবেদন করেও পাননি। তাই বাধ্য হয়ে ভিটি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে ক্রেতাদের কাছে কিছুটা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। আর যদি প্রকৃতভাবে সরকারি মূল্য অনুযায়ী ভিটি বরাদ্দ পেতেন তাহলে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি মূল্য নিতেন না।
শুধু তিনি নন, এরকম প্রায় সব ব্যবসায়ীরাই প্রতিবছরে মোটা অংকের ভাড়ার টাকা আদায়ের জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি মূল্য রেখে থাকেন।
করটিয়া হাটের হোটেল ব্যবসায়ী প্রল্লাদ দাস জানান, তিনি ভিটি বরাদ্দের বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে তিনি গত ৩-৪ বছর আগে আনিসুর রহমান বিরুর কাছ থেকে একটি ভিটি কিনে হোটেল ব্যবসা করছেন।
আনিসুর রহমান বিরু জানান, বর্তমানে তার কাছে কোনো ভিটি খালি নেই। তবে যেগুলো ছিল, সেগুলো সব ভাড়া দিয়েছেন। ভিটি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী ও প্রল্লাদ দাস দেখেন। তারাই ঠিক করেন, কার ভাগে কয়টি ভিটি পড়বে বলেও জানান তিনি।
ছানোয়ার হোসেন ছানু জানান, এবার যাদের ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তারা আগে থেকেই সেখানে দখলে ছিলেন। আর একজন ব্যবসায়ী একটি মাত্র ভিটি পাবেন। তবে তার পরিবার বড় হওয়ায় তিনি ও তার স্বজনরা মিলে ১০-১২টি ভিটি বরাদ্দ পেয়েছেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী জানান, করটিয়া হাটে আগে থেকেই যারা ভিটি দখল করে ছিলেন তাদের মাঝেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন ভাবে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।