টাঙ্গাইলের একমাত্র নারী অটোরিক্সা চালক রোজিনার জীবন যুদ্ধ


০৮:৫৫ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
টাঙ্গাইলের একমাত্র নারী অটোরিক্সা চালক রোজিনার জীবন যুদ্ধ - Ekotar Kantho
টাঙ্গাইল শহর দিয়ে অটোরিক্সা চালাচ্ছেন রোজিনা বেগম

একতার কণ্ঠঃ টাঙ্গাইল পৌরসভায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার চালকদের মধ্যে একমাত্র নারী চালক রোজিনা বেগম। তার বাড়ি জেলার বাসাইল উপজেলার আইসড়া গ্রামে। টাঙ্গাইল পৌর শহরের এক প্রান্ত রাবনা বাইপাস আরেক প্রান্ত বেবিস্ট্যান্ড। রাস্তায় প্রতিদিন এভাবেই ভাড়ায় চালিত অটোরিক্সায় যাত্রী নিয়ে অটো চালাতে দেখা যায় রোজিনাকে।

শহরে যানজটের পাশাপাশি নানা ধরনের ঝামেলা সামলে পুরুষ চালকদের যখন অটোরিক্সা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, এমতো অস্থায় গত ৫ বছর ধরে একমাত্র নারী অটোরিক্সা চালক রোজিনা এই অটোরিক্সা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছে।

টাঙ্গাইল পৌরসভা সূত্রে জানা যাায়, টাঙ্গাইল শহরে চলাচলের জন্য ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক ও ৫ হাজার ব্যাটারিচালিত রিক্সা অনুমতি (লাইসেন্স) দেওয়া হয়েছে। যানজট এড়াতে ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক জোড় ও বিজোড় সংখ্যায় ভাগ করা হয়েছে। সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত এক ভাগ এবং বেলা দুইটা থেকে রাত পর্যন্ত আরেক ভাগের ইজিবাইক চলাচল করার নির্দেশনা দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রোজিনাকে দুই শিফটে চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন পৌর কর্তৃপক্ষ।


সরেজমিনে দেখা যায়, টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অটোরিক্সার স্টিয়ারিংয়ে বসে যাত্রী ডাকছেন- কলেজ গেট, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ক্যাপসুল মার্কেট, নিরালা মোড়, বেবিস্ট্যান্ড। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ৩ জন যাত্রী নামবে। ট্রাফিক পুলিশ অন্য অটো চালকদের অটো দাঁড় করাতে না দিলেও রোজিনা অটো দাঁড়া করে তিনজন যাত্রীকে নামাতে দিচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশসহ অটোচালকরা তাকে সব সময় সহযোগিতা করেন।

অটোরিক্সার চালক রোজিনা বলেন, আমার অটোতে নারী যাত্রীরা খুব কম উঠে। তারা মনে করে আমার অটোতে উঠলে দূর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু আমার অটোতে ছেলে যাত্রীরাই বেশি উঠে। আমি খুব হিসেব করে অটো চালাই। খুব দ্রুত গতিতেও না, আবার একেবারে ধীরগতিতেও না। এখন পর্যন্ত আমি কোন দূর্ঘটনার কবলে পড়ি নাই। শহরের পুরুষ অটোরিক্সা চালকরা আমাকে অনেক সম্মান করে। আমি যখন রাস্তার ওপর অটো ঘুরাই তারা নিজেদের অটো দাঁড়া করে রেখে আমাকে অটো ঘুরাতে সুযোগ করে দেন। বড় গাড়ির চালকরাও যখন আমাকে দেখেন আমি নারী চালক তখন তারাও আমার প্রতি সম্মান দেখান।

অটোচালক কাদের মিয়া বলেন, আমাদের শহরে কয়েক হাজার অটো চলাচল করে। তার মধ্যে একমাত্র নারী চালক রোজিনা। তিনি খুব সাবধানে অটো চালান। তাকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করি। যদি দেখি সে রাস্তায় অটো ঘুরাচ্ছে তখন আমাদের অটো দাঁড়া করিয়ে তাকে অটো ঘুরানোর জন্য সুযোগ করে দেই। আমরা চাই তাকে সরকারি ভাবে সহযোগিতা করা হোক।

অটোরিক্সার যাত্রী সাইদ মিয়া বলেন, আমি এ পর্যন্ত ৫-৬ বার রোজিনার অটোতে উঠেছি। অটোর চালক নারী দেখেও আমি তার অটোতে উঠি। তিনি খুব সাবধানে অটো চালান। অন্য পুরুষ অটো চালকের চেয়ে তার অটো চালানো অনেক ভালো। তাকে যদি সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়। সে একটু ভালো ভাবে চলতে পারবে।

আরেক যাত্রী বক্কর মিয়া বলেন, নারী অটো চালকের পাশের সিটে বসতে কিছুটা সংকোচবোধ হলেও তিনি কোন সংকোচবোধ মনে করেন না। তিনি খুব সাবধানে অটো চালায়।

রোজিনার সাহসিকতা দেখে নারী সংগঠক সিরাজুমমনি বলেন, তিনি অনেক দিন যাবত অটোরিক্সা চালায় আমি রোজিনাকে স্যালুট জানাই। একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারী কোনো দিক থেকে কম নন, রোজিনা তা প্রমাণ করেছেন। জনপ্রতিনিধি ও সরকারিভাবে তাকে কোন একটা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দিলে তার আর রাস্তায় অটো চালাতে হবে না বলে আমি মনে করি।

অটোরিক্সায় বসে রোজিনার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, রোজিনার বাবা একজন তাঁত শ্রমিক। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় মেয়ে রোজিনা। অভাব-অনটনের সংসারে বাবা-মা তাকে এক এতিম যুবকের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের পর জন্ম হয় দুই কন্যা সন্তানের। অটোরিক্সা চালিয়ে কোন রকম সংসার চালাচ্ছিলেন স্বামী রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় রফিকুলের এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি চোখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত চোখের দৃষ্টি শক্তি আরও কমতে থাকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে অটোরিক্সা চালানো। সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটি অচল হয়ে পড়ায় স্বামীর চিকিৎসার খরচ, ঘর ভাড়া, খাওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, দিশেহারা হয়ে পরেন তিনি। পরে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার তাও চলছিল না। এরপর এনজিও থেকে ধার করে কোন রকম সংসার চালাতে পারলেও মেয়েদের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ জোগাড় করতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে রোজিনা নিজে অটোরিক্সা চালাতে আগ্রহ হয়। স্বামী রফিকুলের কাছে তা শিখতে চান। গ্রামের স্কুলের মাঠে স্বামীর কাছে অটোরিক্সা চালানো শিখেন রোজিনা। পরে গ্রামের পথে ৫-৬ দিন শিখে বাড়ি থেকে অটোরিক্সা নিয়ে একদিন সরাসরি টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন রোজিনা। এভাবে ধীরে ধীরে অটোরিক্সা চালানো শুরু হয় তার।

তিনি বলেন, অটো চালানোর চিন্তাটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। ৫ বছর ও ১০ বছরের দুই মেয়েকে বাড়িতে রেখে অটোরিক্সা নিয়ে সারাদিন রাস্তায় থাকতে হয়। তাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করতে পারি না। কি করবো অভাবের সংসার। ভাড়া বাড়িতে থাকার খরচ কমাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটু জমি কিনি। পরে সেখানে সরকার আমাকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তুলে দেয়।

রোজিনা বলেন, যখন খুব অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছিলাম তখন মানুষ আমাদের ঠাট্টা করেছে। যখন জীবনের তাগিদে অটোরিক্সা চালাতে শুরু করি তখনও নানা কথা বলেছে। তবে এখন তারাই আমাকে সম্মান করেন। নারীরাও কিছু করতে পারে।

রোজিনা আরও বলেন, আমার দুই মেয়ে, বড় মেয়ে আইসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে ছোট মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। আমার তো থেমে গেলো চলবে না। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। ধারদেনা শোধ করতে হবে। আমি অটোরিক্সা চালিয়েই দুই সন্তান মানুষ করতে চাই। আমার পাশে যদি সরকার দাঁড়ায় তাহলে আমি অটোরিক্সা চালানো বাদ দিয়ে অন্য কোন কাজ করবো।

টাঙ্গাইলের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, শহরের একমাত্র নারী অটোরিক্সা চালক রোজিনা। কেউ যেন তাকে বিরক্ত করতে না পারে সেদিকে ট্রাফিক পুলিশ সব সময় নজর রাখে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ তাকে সব সময় সহযোগিতা করে।

টাঙ্গাইলের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহ আলম বলেন, আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম। ওই নারী এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসে নাই। সে যদি আমাদের কাছে এসে আবেদন করে অবশ্যই তাকে আমরা সহযেগিতা করবো, তার পাশে দাঁড়াবো।


খবরটি শেয়ার করুন

কপিরাইট © ২০২২ একতার কণ্ঠ এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি ।