একতার কণ্ঠ ডেক্সঃ বয়স তার ৫০, নাম সুবল রাজবংশী। অনাহার-অর্ধাহারে জীর্ণ শরীর। বয়সের ভারে নয় পুষ্টির অভাবে ন্যূয়ে পড়েছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত সুবল রাজবংশী বর্তমানে নিজ ভূমে পরবাসী। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের সূতানরী গ্রামে।
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৬০ শতক ভূমি ১৫ বছর ধরে গ্রামের প্রভাবশালীরা জবর দখল করে রেখেছে। সুবলের বসতভিটা-জমি নিয়ে গ্রাম্য সালিশ-দরবার হয়েছে বিস্তর, কোন সমাধান হয়নি।
সংখ্যালঘু হওয়ায় প্রভাবশালীদের ভয়ে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে গ্রামে যেতে পারেন না তিনি- যে কোন সময় চাপে ফেলে বাড়ি-জমি লিখে নিতে পারে জবর দখল কারীরা।
কিছুদিন বাস করেছেন মামা চান মোহন রাজবংশীর বাড়িতে। এখন তিনি গাজিপুরের চন্দ্রায় ভাড়া ঝুঁপড়িতে স্ত্রী চিত্রা রাজবংশীকে নিয়ে বাস করছেন এবং কিশোর ছেলে সুকুমার রাজবংশীকে(১১) নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দিনমজুরি করে দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলতে গিয়ে ছেলের ভবিষ্যত ভাবনায় হামেশাই অশ্রু ঝড়ান সুবল।
সরেজমিনে জানা গেছে, ফতেহপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর মৌজার গ্রামের স্বর্গীয় গণেশ রাজবংশীর ছেলে সুবল রাজবংশীরা বংশ পরম্পরায় সূতানরী গ্রামের বাসিন্দা। সুবল রাজবংশী দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে বিনোদিনী রাজবংশী ও নূপুর রাজবংশীকে অন্য উপজেলায় বিয়ে দিয়েছেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় স্থানীয় ছালাম খান, মানিক খান, হযরত খান, ফরিদ খান ও ছানু খানের পূর্বপুরুষরা আসাম থেকে এসে সূতানরী গ্রামে বসতি স্থাপন করে।
সুবল রাজবংশীর বিএস-৩২৮ খতিয়ানে ২২৪ নং দাগের ২৪ শতক বসত ভিটা ভাগাভাগি করে বসবাস করছেন একই গ্রামের মৃত মজিদ খানের দুই ছেলে ছালাম খান ও মানিক খান এবং মৃত রুস্তম খানের ছেলে হযরত খান ও মৃত কাশেম খানের ছেলে ফরিদ খান।
একই খতিয়ানের ২২৩ দাগের ১৯ শতাংশ কান্দা ভূমি ছালাম খান ও মানিক খান জবরদখলের মাধ্যমে ভোগ করছেন। ওই খতিয়ানের ৪৫৯ দাগের ১৭ শতাংশ নামা ভূমি মৃত ধলা খানের ছেলে ছানু খানের দখলে রয়েছে। নিজ নামে পৈত্রিক ৬০ শতাংশ বাড়ি-জমির মালিক হলেও সুবল রাজবংশী সংখ্যালঘু হওয়ায় প্রভাবশালীরা তাকে পরিবারসহ সূতানরী গ্রাম থেকে কৌশলে বিতারিত করেছে।
এ বিষয়ে সুবল রাজবংশী ইতোপূর্বে মির্জাপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই জিডির পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষকে মির্জাপুর থানায় তলব করা হয়- সেখানেও বিষয়টির কোন সমাধান হয়নি। সর্বশেষ সুবল রাজবংশী গত ২৫ জানুয়ারি প্রতিকার চেয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
সূতানরী গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ মিয়া(৬৫), আব্দুল করিম(৭০), নিরঞ্জন রাজবংশী(৫০), নরেশ রাজবংশী(৪০) সহ অনেকেই জানান, সুবল রাজবংশী অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। স্থানীয় নদী ও মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার বাবা-কাকারা তিন ভাই ছিলেন- স্বর্গীয় গণেশ রাজবংশী, স্বর্গীয় জিতেন রাজবংশী ও স্বর্গীয় জিনি রাজবংশী। স্বর্গীয় জিতেন রাজবংশী ও স্বর্গীয় জিনি রাজবংশী স্বাধীনতার আগে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে চলে যান।
কিন্তু স্বর্গীয় গণেশ রাজবংশী তার অংশের সম্পত্তি বিক্রি করেন নাই এবং সুবল রাজবংশী অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকাকালে দেশেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সুবল রাজবংশী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, পৈত্রিক ৬০ শতক বসতবাড়ি-জমি থাকা সত্বেও তিনি ভূমি ও ঠিকানাহীন। সংখ্যালঘু হওয়ায় তার সম্পত্তি ছালাম খান ও তার আত্মীয়রা গায়ের জোরে জবরদখল করে নিয়েছে।
বার বার গ্রাম্য সালিশ-বিচারে উপস্থিত হয়ে জমির কাগজপত্র দেখিয়েও তিনি বাড়ির দখল ফিরে পাননি। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করায় ডিবি এলাকায় গিয়ে তদন্ত করে এসেছে। কিন্তু কোন প্রতিবেদন দেয় নাই। এলাকায় থাকলে জবরদখলকারীরা তাকে মেরে ফেলতে পারে তাই তিনি স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে চন্দ্রায় দিনমজুরি করে কোন রকমে বেঁচে আছেন।
অভিযুক্ত ছালাম খানের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী বয়োবৃদ্ধ রহিমা খানম জানান, সুবল রাজবংশী বাড়ির কিছু অংশের মালিক। সুবল চাইলে বসবাসের জন্য তারা বাড়ি ছেড়ে দেবেন। তবে সুবল যদি তার জায়গা বিক্রি করতে চায় তারা বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কিনে রাখবেন।
ছালাম খানের ভাতিজা মো. রুবেল খান জানান, তারা কারো সম্পত্তি জবরদখল করেননি। বাড়ি ও জমির দলিল তাদের কাছে রয়েছে। প্রয়োজনে যথাস্থানে উপস্থাপন করা হবে। তবে সুবল যদি জায়গা বিক্রি করতে চায় তারা কিনে নেবেন।
ফতেহপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. মজনু মিয়া জানান, বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে বার বার সালিশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম দিকে অভিযুক্ত ছালাম খানরা তাদের কাছে ওই জমির দলিল আছে বলে জানিয়েছে পরে আর কোনদিন সালিশে হাজির হয়নি।
ফতেহপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রৌফ মিয়া জানান, সুবল রাজবংশীর বাড়ি ও জমি নিয়ে একাধিকবার ইউনিয়ন পরিষদে সালিশের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। ছালাম খানরা বিষয়টির সমাধান চাইলেও পরে আর সালিশে উপস্থিত হয়নি। মূলত: সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন তালুকদারের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিমাংসা করা সম্ভব হয়নি।
টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি-দক্ষিণ) অফিসার ইনচার্জ আমীর হোসেন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত নন। তিনি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।